টেকনোলজি ও ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ‘ডিজিটাল আসক্তি’ নামে পরিচিত। ডিজিটাল আসক্তির তিনটি ধরন আছে—ফোন, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া। মানুষের আবেগ ও অনুভূতির ওপর এগুলো মারাত্মক ধরনের প্রভাব ফেলেছে। প্রভাব ফেলছে ধর্মীয় আচার ও নৈতিক জীবনাচারের ক্ষেত্রেও।
জীবনের ওপর আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো—
পুরস্কার ও প্রতিদান পাওয়ার স্পৃহা : মানুষ স্বভাবগতভাবে বাহবা পেতে চায়। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষ আরো বেশি ‘লাইক’ ও ‘লাভ’ পাওয়ার প্রত্যাশায় বিভোর থাকে।
ত্বরাপ্রবণতা : প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন মানুষ কম সময়ে বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চায়। যে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে ২৫-৩০ বছর সময় লাগে, অল্পতেই সে এমন পরিপক্ব হতে চায় বা হওয়ার দাবি করে।
নতুনত্বে আগ্রহ : মানুষ স্বভাবগতভাবে নতুন কিছু দেখতে চায়, পেতে চায়। আধুনিক প্রযুক্তি বিশেষভাবে সোশ্যাল মিডিয়া প্রতি ১৫ সেকেন্ড পরপর নতুন কিছু হাজির করে।
অলসতা : সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় শুধু আঙুল হেলানোর মাধ্যমে। এর জন্য এর চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। এই প্রবণতা অলসতা ও উদাসীনতা তৈরি করে।
বিস্ময়াবিষ্ট ও অভিভূত হওয়ার চরম আগ্রহ : মানুষ আশ্চর্য বস্তু দেখতে ভালোবাসে। প্রযুক্তি মানব-মনের এই বাসনা আরো বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এক বসায় মানুষ এখন দুনিয়ার সব আশ্চর্যজনক বস্তু দেখতে পারে।
স্তুতি ও প্রশংসা লাভের আকুতি : মানুষ অন্যের মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে চায়। যে প্রশংসা সারা জীবন পাওয়া যেত না, তা এখন অতি দ্রুত পাওয়া যায়। একটি ছবি পোস্ট করার সঙ্গে ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আল-হামদুলিল্লাহ’-এর বন্যা বয়ে যায়। এতে সে পুলকিত হয়।
নিজেকে ‘মেকি বিউটিফুল’ বানানোর আগ্রহ : মানুষ নিজেকে সুন্দররূপে দেখাতে চায়। আধুনিক প্রযুক্তি এখন মানুষকে ‘কৃত্রিম সুন্দর’ বানানোর প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছে।
রঙের প্রতি অনুরাগ : প্রযুক্তির যুগে মানুষের দেহ-মনে রং লেগেছে। মানুষ রংবেরঙের কালার ব্যবহার করে নিজেকে রঙিন করে তোলে।
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা : মানুষ নিজেকে বড় বানাতে চায়; কিন্তু পরিশ্রম করে না। প্রযুক্তির যুগে মানুষ বাস্তব জীবনে যত ক্ষুদ্র হোক না কেন, নিজেকে ‘বড়’ হিসেবে জাহির করে।
অর্থলোভ : প্রযুক্তিতে আসক্ত লোকেরা পরিশ্রম না করে পয়সা কামাই করতে চায়। যে পরিমাণ সময় যে প্রযুক্তির পেছনে ব্যয় করে, বাস্তব জীবনে তা ব্যয় করলে আরো বেশি অর্থ কামাই করতে পারত। কিন্তু সে বসে বসে অর্থ পেতে চায়। এমনকি কেউ কেউ এর জন্য ডিজিটাল প্রতারণার আশ্রয় নেয়।
বেপরোয়া মনোবৃত্তি : প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকতে চায়। সে চায়, কেউ তার কাজে কৈফিয়ত তলব না করুক, হস্তক্ষেপ না করুক।
দুর্নাম হওয়ার ভয় নেই : নাম বদলে, ছদ্মনাম ব্যবহার করে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। কোনো নিষিদ্ধ কাজ করতে তার ভয় নেই। ফলে সহজেই কাউকে ডিস্টার্ব, কারো সঙ্গে প্রতারণা কিংবা প্রেম করতে পারে। এতে বদনাম হওয়ার ভয় নেই।
সুখ্যাতির আসক্তি : প্রযুক্তিতে আসক্ত মানুষ রাতারাতি নিজেকে খ্যাতিমান করে তুলতে চায়। ভাইরাল হতে চায় এবং বেশি ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ পাওয়ার জন্য উদ্ভট কাজ করে বসে।
মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ : সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষ অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে যার পর নাই কোশেশ করে।
অনুসন্ধান প্রবণতা : মানুষ জানতে চায়। কিন্তু প্রযুক্তিতে আসক্ত মানুষ বরাবরই অন্যের গোপন কিছু খুঁজে বেড়ায়। সব সময় যেন সে কিছু খুঁজতে থাকে।
কামাসক্তি : প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মানুষ বিনোদনের নামে নগ্নপথ খোঁজে নেয় এবং তার ভেতর ধীরে ধীরে কামাসক্তি প্রবলভাবে বাড়তে থাকে।
সৃষ্টিশীল হওয়ার অভিনয় : নিজেকে সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীল প্রমাণ করতে প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ নানা ছলছাতুরি করে। অন্যের গান, কথা ও কাজের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে কিংবা অভিনয় করে সে নিজেকে ‘ক্রিয়েটিভ’ প্রমাণ করতে চায়।
পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক প্রভাব : মানুষ বরাবরই পরিবেশ দিয়ে প্রভাবিত হয়। প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ আরো বেশি অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়, যেখানে যা দেখে, যাকে যা করতে দেখে নিজে তা শুরু করে দেয়। এতে বাসনা ও চাওয়া-পাওয়ার শেষ থাকে না।
উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে জীবন : প্রযুক্তিনির্ভর জীবনের কোনো লক্ষ্য থাকে না—শুধুই সময়ক্ষেপণ। কখনো জানা-অজানা, কখনো বিনোদন, কখনো সৌন্দর্য দর্শন, কখনো উত্তেজক দৃশ্য দেখে সময় পার করাই জীবনের লক্ষ্য হয়ে থাকে। এমন মানুষ এক ধরনের ভবঘুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
সব কিছু অন্যের সঙ্গে তুলনা করার মনোবৃত্তি : প্রযুক্তিতে আসক্ত মানুষ নিজের সব কিছু অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করে। সব সময় অন্যকে সুখী ভাবে। অন্যকে নিজের জন্য আদর্শ মনে করে। অথচ সে নিজের সুখ ও প্রাপ্তির মূল্যায়ন করার সুযোগ পায় না।