এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের এক নিষেধাজ্ঞা বেশ বিপাকে ফেলেছিল সরকারকে। এখন নির্বাচনের আগে আবার নিষেধাজ্ঞা আসতে পারেএমন আশঙ্কা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়। বিভিন্ন অজুহাতে একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে এবার সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দায়ত্বশীল ব্যক্তিদের ওপর এই আশঙ্কায় বহির্বিশ্বে থাকা বাংলাদেশের সব দূতাবাস ও মিশনকে
সতর্ক থাকতে বলা হয়েছেসতর্কতার নির্দেশ দিয়ে দূতাবাস ও মিশনপ্রধানদের চিঠি পাঠিয়েছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।
পররাষ্ট্রসচিব এ চিঠি দিয়েছেন গত ৩১ ডিসেম্বরইউরোপে নিযুক্ত একটি দেশের রাষ্ট্রদূত এ চিঠি পেয়েছেন বলে আজকের পত্রিকাকে নিশ্চিত করেছেনওই চিঠি পাঠানোর পরদিন ১ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও এক অনলাইন বৈঠকে নির্বাচনের বছরে সতর্ক থাকার জন্য বিদেশে রাষ্ট্রদূতদের নির্দেশ দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী গতকাল শনিবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, র্যাবের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টির উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে রাষ্ট্রদূতদের সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পররাষ্ট্রসচিবের পাঠানো চিঠিতে বর্তমান বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে দূতাবাসগুলোকে আরও সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। র্যাবের নাম উল্লেখ না করে চিঠিতে এর আগে ‘এলিট’ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর মার্কিন একতরফা নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। বলা হয়, এখন যেকোনো অজুহাতে সরকারি সংস্থার কোনো কোনো ব্যবসায়ী যারা সরকারকে আর্থীকভাবে সহযোগীতা করে এবং সুবিধা নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে তাছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিন এ খানের বিরুদ্ধের যুক্তরাস্ট্রে অবৈধ উপায়ে ১৪টি বাড়ি কেনার অভিযোগ উঠলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাকসিনের যুক্তরাস্ট্রে টাকা প্রবেশেরে ওপর গোয়েন্দা নজরদারী জোরদার করেছে। যে কোনো সময়ে তাকসের উপর যুক্তরাস্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে সূত্রগুলো জানায়।
এর মধ্যে বহুজাতিক গ্রূপ এস আলমের নাম উল্লেখযোগ্য। কারন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটে গেল এই মন্দার সময়ে৷ একটি শিল্প গ্রুপ ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে৷ শিল্প গ্রুপটি হলো বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপ৷
এই গ্রুপের মালিক এবং পরিবারের সদস্যদের মোট আটটি ব্যাংকের মালিকানা আছে৷ তাদের আছে নানান কিসিমের ব্যবসা৷ কোনোটি জীবন্ত আবার কোনোটি অস্তিত্বহীন৷ তারা আবার মিডিয়ারও মালিক ৷
ইসলামী ব্যাংক ২০১৭ সালে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়৷
প্রথম খবরটি ছিল ইসলামী ব্যাংক থেকে নভেম্বর মাসেই দুটি ভুয়া কোম্পানি খুলে দুই হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে৷ প্রতিষ্ঠান দুটি হলো নাবিল গ্রুপ ও মার্টস বিজনেস লাইন৷ এর বাইরে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্ষ্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে দুই হাজার ৩২০ কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে নভেম্বরে নিয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা৷
এর পরপরই বুধবার এই সংক্রান্ত আরো একটি খবরে তোলাপাড়া শুরু হয় হলো৷ এস আলম গ্রুপ এককভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে৷ এর এই ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রনাধীন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান৷ এস আলম গ্রুপ সর্বোচ্চ ২১৫ কোটি টাকা ঋণ নিতে পারে৷ আরো বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক সন্দেহ করছে এস আলম গ্রুপ এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত পক্ষগুলো মোট এক লাখ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে৷ এসব তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিটি রিপোর্টের বরাতেই দেয়া হয়েছে৷ আর সেখানে অনিয়মের কথা বলা হয়েছে৷ এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল আলম এখন সিঙ্গাপুরে বসবাস করেন৷
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এই ঋণকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারি হিসেবে অভিহিত করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এক ব্যক্তির হাতে আটটি ব্যাংক দিলে যে এই পরিণতি হবে তা আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবিরকে প্রকাশ্যেই বলেছিলাম৷’’
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত এতে বিস্মিত হয়েছেন৷ তাই আদালত বুধবার ইসলামী ব্যাংক থেকে এই ঋণ নেয়ার ব্যাপারে রিট করতে বলেছেন৷ আর বৃহস্পতিবার আরেকটি আদালত এখন থেকে ঋণ গ্রহীতার নাম ও ঠিকানা ব্যাংকগুলোকে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে৷
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য তদন্ত শুরুর কথা বললেও কোনো মন্তব্য করছে না৷ আর এস আলম গ্রুপও এখন মুখে কুলুপ এঁটেছে৷ সরকারও এই বিষয়ে এখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে৷ কিন্তু বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না চাইলে কিছু হয় না৷ তিনি চাইলে এদরকে ধরা এবং টাকা উদ্ধার সম্ভব, অন্যথায় নয়৷’’
এই অবস্থায় সরকার এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ক্ষতিকর তৎপরতা রুখে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদূতদের নিজ নিজ দায়িত্বের এলাকায় অত্যন্ত সতর্ক ও সজাগ থাকতে চিঠিতে নির্দেশনা দেন পররাষ্ট্রসচিব। তিনি বলেন, একই সঙ্গে এ ধরনের তৎপরতা আগেভাগেই রুখে দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। এ বিষয়ে দূতাবাস ও মিশনপ্রধানদের নিয়মিত অবহিত করবে মন্ত্রণালয় এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাবে।
পররাষ্ট্রসচিবের এই সতর্কতামূলক চিঠি দেওয়াকে একটি ‘সঠিক উদ্যোগ’ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একজন সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধজ্ঞা আনার জন্য তৎপরতা আছে, এটা ঠিক। আগেই সতর্ক থাকলে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাও হয়তো এড়ানো যেত।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্য ও কানাডার সঙ্গে সমন্বয় করে জারি হয়েছিল এই নিষেধাজ্ঞা। এখন নির্বাচনের আগের বছরে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসগুলোর সঙ্গে একধরনের টানাপোড়েন চলছে। ঠিক এমন সময়ে নিজের দূতাবাস ও মিশনগুলোকে সতর্ক করল মন্ত্রণালয়।
র্যাবের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক জবাব পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের কাছে চিঠিটি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
আব্দুল মোমেন চিঠিতে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদকসহ আন্তরাষ্ট্রীয় অপরাধ দমনে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেছেন। চিঠিতে র্যাবসহ বাংলাদেশের অন্য বাহিনীগুলোর অবদানের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়।
২৮ ডিসেম্বর মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ল ফার্ম নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার।