বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) আমদানিকে ঘিরে বিভিন্ন অপতৎপরতা এবং অর্থ পাচারের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এরিই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ইরানি দুটি জাহাজে এলপিজি আমদানি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি গ্যাস আমদানি না করে বাজারকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র চলছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া, ১২ অক্টোবর দিবাগত রাতে কুতুবদিয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন এলপিজি সোফিয়া ট্যাংকার আগুন লাগার ঘটনা এই ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে বলে আশঙ্কা জানিয়েছেন জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী এবং বিশেষজ্ঞরা। পরপর কয়েকটি জাহাজে আগুন, দুর্ঘটনা না ষড়যন্ত্র তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তারা।
দেশের এলপিজি গ্যাসের চাহিদা মাসিক কম বেশি এক লাখ ২০ হাজার টর। নগর ও শিল্পায়ন এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের স্বল্পতার কারণে দিন দিন এলপিজির চাহিদা বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সরকার অনুমোদিত বেসরকারি ২৬টি কোম্পানি বর্তমানে গ্যাসের যোগান দিয়ে যাচ্ছে, যার ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সাথে মিল রেখে সৌদি আরবের বাজার প্রাইসে এলপিজি বাংলাদেশে আমদানি ও বাজারজাত করা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানি আন্তর্জাতিক বাজারে দর কষাকষি করার মাধ্যমে সব সময় সাশ্রয়ী মূল্যে এলপিজি আমদানির চেষ্টা করে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে দেশে এলপিজির সরবরাহ এবং সরকারের আমদানিতে ডলার সাশ্রয় হবার পাশাপাশি রিজার্ভ সঙ্কটের সময়েও সহায়ক ভূমিকা রাখে।
এছাড়া প্রতিবেশী ভারতও কম দামে এলপিজি গ্যাস আমদানি করে থাকে। এই খাতে অবকাঠামো উন্নয়নও করেছে দেশটি। এলপিজি রপ্তানি বিষয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে
সম্প্রতি একটি সমঝোতাও হয়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক আমদানি জাহাজের ব্যয় নির্ধারণ হয়, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হতে এলপিজি আমদানি সাশ্রয়ী এবং কম সময়ে আনা যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন এলপিজি কোম্পানি তাদের নিজস্ব প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সরবরাহকারী হতে এলপিজি আমদানি করেছে।
কাস্টমসের ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কিছুটা সাশ্রয় মূল্যে এলপিজি আমদানি সরকারের ব্যয় সংকোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সাথে সাথে সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে এলপিজি সরবরাহ করে আসছে। ফলে ভোক্তা তার পণ্য সঠিক সময়ে এবং সঠিক দামে পাচ্ছেন।
কিন্তু দু’একটি এলপিজি কোম্পানি বাজারে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে সাশ্রয় মূল্যে আমদানি না করতে বিভিন্ন প্রকার বাধা দিয়ে এবং মনগড়া প্রতিবেদন দিয়ে উক্ত আমদানিকে হুমকির মুখে এবং বাজার অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।
একটি বেসরকারি কোম্পানি বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে জ্বালানি খাতে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলো বলে অভিযোগ আছে। ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটিই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসির জ্বালানি তেল পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করতো বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি ৭৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নতুন একটি অয়েল ট্যাংকার নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। যা বাংলাদেশের জ্বালানি পরিবহনে ব্যবহার হবে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি সরকারি দুটি অয়েল ট্যাংকার (বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি) এ অগ্নিদুর্ঘটনা ষড়যন্ত্রমূলক বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। জ্বালানি পরিবহনে সরকারি জাহাজের ব্যবহার সীমিত হলে বেসরকারি খাতের একটি প্রতিষ্ঠান লাভবান হবে।
এছাড়া কিছু কোম্পানি এলপিজি আমদানিতেও প্রতি টনে ২০ হতে ৪০ ডলারের অধিক দেখিয়ে দেশের অর্থ বিনষ্ট করার পাশাপাশি অর্থপাচার করছে বলে সংশ্লিষ্ট মহল সন্দেহ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে অর্থ পাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এই খাতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
গেলো ৬ অক্টোবর এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) এর লেটার প্যাডে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যানকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠির বিষয়ে অ্যাসোসিয়েসনের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, কারও সাথেই আলোচনা না করে অ্যাসোসিয়েসনের সভাপতি ব্যক্তি ইচ্ছায় এবং ব্যবসায়িক প্রতিহিংসামলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
চিঠিতে উল্লেখ্য দুটি জাহাজের নাম (জিএমএস এবং নিকোলাস) ব্যবহার করে বলা হয়েছে তারা ইরান হতে এলপিজি সংগ্রহ করে ডকুমেন্টে লোড পোর্ট ইরাক দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে জাহাজ দুটির বিভিন্ন ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করে জানা গেছে, আসলে ওই দুই জাহাজ করে আমদানি করা এলপিজি কেনা হয়েছে যুক্তরাজ্য এবং ওমান থেকে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে একটি চক্র সরকারি দপ্তরসমূহকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে জ্বালানি খাতে বিশৃঙ্খলা তৈরির পাঁয়তারা করছে।
বিষয়টি শুধুমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ ও নিজের এলপিজি কোম্পানির অধিক মুনাফা করার অপচেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। জ্বালানি তেলের পাশাপাশি এলপিজি খাত যদি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত হয় তাহলে শুধুমাত্র অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোই ক্ষতির মুখে পড়বে না বরং, ভোক্তার জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। এলপিজির মতো অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি পণ্য যা ভোক্তার দৈনিক চাহিদার সাথে সম্পৃক্ত। যদি এই পণ্যটি একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে, তাহলে দেশের সার্বিক জ্বালানি খাতের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি হবার আশঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশে এলপিজির বাৎসরিক চাহিদা কমবেশি ১.৪ মিলিয়ন টন, যা ২৬টি বেসরকারি কোম্পানির মাধ্যমে উক্ত চাহিদা অনুযায়ী আমদানি পূরণ করে আসছে। আমদানি মূলত মধ্যপ্রাচ্য বিভিন্ন দেশ হতে অথবা ভারত এবং শ্রীলংকা হতে বিভিন্ন ট্রেডারের মাধ্যমে এলপিজি আমদানি করে দেশের চাহিদা পূরণে নিরলস ভূমিকা পালন করে আসছে। ফলে দেশে ভোক্তা সঠিক সময়ে এবং সঠিক দামে এলপিজি পেয়ে আসছে।
দেশের এলপিজি গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এই সুযোগ কাজে লাগাতে একটি কোম্পানি এলপিজি বাজার কুক্ষিগত করার লক্ষ্য লক্ষ্যে বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে সিঙ্গাপুরভিক্তিক এমজেএল (এস) প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে দেশের অর্থ পাচারের নীলনকশা করে, যারা এখনো সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মেনেজ করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
২০২৩ সালে জানুয়ারি হতে ওমেরা প্রেট্রোলিয়াম লিমিটেড কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলপিজি আমদানি শুরু করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো বাংলাদেশ হতে অর্থ পাচার। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত উক্ত কোম্পানি প্রায় পাঁচ লক্ষ টন এলপিজি সিঙ্গাপুরে অবস্থিত তার নিজস্ব কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশে রপ্তানি দেখায়। এলপিজি এশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের দামের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে তা দেখিয়েই এশিয়ার দামে বাংলাদেশে বাজারজাত করে।
যার ফলে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার দেশের বাহিরে পাচার করেছে বলছে অভিযোগ উঠেছে। যার একটি সার-সংক্ষেপ তথ্য উপাত্তসহ উপস্থাপন করা হল-
দেখা যাচ্ছে, ওই কোম্পানি বেশি দাম দেখিয়ে টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করছে। সিঙ্গাপুর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে কিভাবে টাকা যাচ্ছে এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে তাগাদা দিয়েছেন এই খাত সংশ্লিষ্ট। একই কোম্পানি বর্তমানেও একইভাবে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অদ্যবদি দেশের বাজারে সবোর্চ্চ মূল্যে এলপিজি আমদানি দেখিয়ে আসছে।
এতে করে চলতি বছরে আরও ৭০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে পাচার হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই দেশের স্বার্থে সিঙ্গাপুরভিক্তিক প্রতিষ্ঠান এমজেএল (এস) প্রাইভেট
লিমিটেড (রেজিস্ট্রেশন নং- ২০১৬১৩৫১১এইচ) এবং দেশীয় কোম্পানি ওমেরা প্রেট্রোলিয়ামের দেশবিরোধী কাজের সম্পৃক্ততা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর হতে অতি জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট।