জাতীয় প্রেসক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা। ১৭ আগস্ট, ঢাকা
সরকার ইচ্ছে করেই দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে নজর দেয়নি বলে জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাঁরা বলছেন, বর্তমান জ্বালানিসংকট আকস্মিক নয়। নিজস্ব জ্বালানি সক্ষমতা তৈরির বদলে সরকার হাত গুটিয়ে বসে থাকায় এই সংকট দেখা দিয়েছে। দেশের গ্যাসক্ষেত্রে প্রচুর সম্ভাবনা থাকার পরও উত্তোলন না করে একটি গোষ্ঠীকে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট: নাগরিক ভাবন’ শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তাঁরা এ কথা বলেন। আজ বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এ আলোচনার আয়োজন করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম। প্রবন্ধে বলা হয়, দেশের নিজস্ব জ্বালানির অনুসন্ধান ও উত্তোলন না করা এবং বিদেশি জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো জ্বালানিসংকটের কারণ। ২০১৭ সাল থেকে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে বার্ষিক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ কমছে। অতি গ্যাস সম্ভাবনাময় দেশ হওয়ার পরও বিশ্বের অন্যান্য গ্যাসধারক বেসিনের থেকে বাংলাদেশে অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা অনেক কম।
অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘দেশীয় গ্যাস খাতে সম্ভাবনা প্রচুর। গ্যাস অনুসন্ধান না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকাতেই আজকের পরিস্থিতি। সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানের ধারা আরও বেশি হতাশাব্যঞ্জক। ২০১২ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর মিয়ানমারের সমুদ৶বক্ষে অনেক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হলেও বাংলাদেশে তা হয়নি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় সংকট তৈরি হয়। দেশের জ্বালানিসংকট আকস্মিক নয়। এখন যা ঘটছে, তা তৈরি হওয়ার মতো পরিকল্পনাই নেওয়া হয়েছিল। এ সংকটের কারণে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ বলেন, গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির বড় অংশ গেছে কয়েকটি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে, যারা উৎপাদন করেনি, তাদের ভাড়া দিতে। এ সময়ে ৯০ হাজার কোটি টাকা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দেশি-বিদেশি ১২টি কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। কারা পাচ্ছে এই ভর্তুকির টাকা? অথচ এর বোঝা চাপছে জনগণের কাঁধে।
জ্বালানিবিশেষজ্ঞ বিডি রহমতউল্লাহ বলেন, ১৯৯৫ সাল থেকেই বলা হচ্ছে, বছরে মোট জ্বালানি চাহিদার ৫ শতাংশ মেটানো হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। তিনি বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ বানালে পকেটে পয়সা বেশি আসে, বিদেশে টাকা বেশি পাচার করা যাবে। সে কারণে এদিকে নজর রয়েছে। জ্বালানি খাতে জনবান্ধব কোনো প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে না।
জ্বালানিবিষয়ক সাময়িকী এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ারের সম্পাদক মোল্লা আমজাদ বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় দেশে গ্যাসের সম্ভাবনা দেখা গেছে। এই সম্ভাবনাকে সম্পদে পরিণত করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বড় অভাব।
দেশের বর্তমান গ্যাসসংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন জ্বালানি খাতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অরুণ কর্মকার। তিনি বলেন, নিজস্ব জ্বালানি উন্নয়নে সক্ষমতা বাড়ানো হলে এ সংকটে পড়তে হতো না। বিপিসি গত সোমবার ফার্নেস তেলের দাম আরও বাড়িয়েছে। প্রতি লিটার আগে ৭২ টাকা ছিল, দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ টাকা। এই তেল বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি ব্যবহৃত হয়। ফলে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জ্বালানিসংকটকে পুঁজি করে সরকার পকেট ভরছে বলে মন্তব্য করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, ‘আগে বলত খাম্বা আছে, বিদ্যুৎ নেই। এখন তো বিদ্যুতের কারখানা আছে, জ্বালানি ও সঞ্চালন নেই। সরকার এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, জ্বালানিসংকট নিয়ে প্রশ্ন তোলারও সুযোগ নেই। ন্যূনতম জবাবদিহি নেই।’
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘মতলববাজির উন্নয়ন চলছে। যা করা উচিত নয়, তা করা হচ্ছে। যেগুলো করার কথা নয়, সেগুলো করা হচ্ছে। চাচা-ভাতিজাতন্ত্র, মামা-ভাগিনাতন্ত্রে একটি গোষ্ঠী বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দেশে চার কোটির বেশি মানুষ নিম্নবিত্ত। জ্বালানিসংকটে তাঁরা আরও বিপদে পড়বেন।’