উত্তরের অন্যতম উচ্চবিদ্যাপিঠ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার (১২ অক্টোবর) পা রাখলো দেড় দশকে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিয়ে যেমন তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক, তেমনি এটি এখন উচ্চশিক্ষার অন্যতম মনুমেন্ট। সময়ের পরিক্রমায় ২২টি বিভাগের প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থীর মুগ্ধ পথচলা এখানে। সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি চলতি বছরের মধ্যেই ক্যাম্পাসকে সেশনজটমুক্ত ঘোষণা করার কথা জানিয়েছেন ভিসি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও তথ্য বিভাগের উপ পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের অধীনে ২২টি বিভাগে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলছে। মোট শিক্ষক রয়েছেন ১৮৪ জন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় আট হাজার। নির্মাণাধীন একটি ছাত্রী হলসহ মোট চারটি আবাসিক হল, প্রশাসনিক ভবন, চারটি অ্যাকাডেমিক ভবন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, মসজিদ ক্যাফেটেরিয়া ভবনসহ আবাসিক স্থাপনায় দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসটির ১৪ বছর পেরিয়ে পনেরতম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষ্যে নানা আয়োজন থাকছে দিনটিতে।
তিনি জানান, ‘প্রতিষ্ঠা দিবসের অঙ্গীকার, সেশনজটমুক্ত হবে এবার’ প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে গ্রহণ করা হয়েছে নানা কর্মসূচি। এ উপলক্ষ্যে সকালে জাতীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি এবং মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, বৃক্ষরোপণ, আনন্দ শোভাযাত্রা এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন।
পিনপতন নীরবতায় সর্বশ্রেণিপেশার মানুষের দীর্ঘ আন্দোলনের এক পর্যায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুৎফর রহমানকে প্রথম ভিসি নিয়োগের মাধ্যমে ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল ৩০০ শিক্ষার্থী ও ১২ জন শিক্ষক নিয়ে রংপুর মহানগরীর ধাপ লালকুঠি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। ২০১১ সালের ৮ জানুয়ারি ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজের ৭৫ একর অধিগ্রহণকৃত জমিতে লালবাগ ও মডার্ন মোড়ের মাঝামাঝি এলাকায় নিজস্ব ক্যাম্পাসে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। উচ্চতর গবেষণার জন্য রয়েছে ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট।
এরই মধ্যে এখানে ভিসি বদল হয়েছে পাঁচ দফায়। দ্বিতীয় ভিসি হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল জলিল মিয়া, তৃতীয় ভিসি হিসেবে ড. একেএম নূর-উন-নবী, চতুর্থ ভিসি হিসেবে ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ এবং পঞ্চম ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশিদ।
দ্বিতীয় ভিসি থেকে চতুর্থ ভিসির আমলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে নজীরবিহীন শিক্ষক-ছাত্র আন্দোলন। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, পদোন্নতিসহ সব কিছুতেই ভিসিদের আস্থাভাজনদের বসানো, যোগ্যদের অবমূল্যায়ণ করাসহ নানা কারণে এসব আন্দোলনে ক্যাম্পাস বন্ধ থেকেছে মাসের পর মাস। আন্দোলন-পাল্টা আন্দোলনের নামে শিক্ষকদের একাংশ ভিসিপন্থী এবং অপরাংশ ভিসিবিরোধী অবস্থানে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে গিয়ে এসময় সেশনজটের গ্যাঁড়াকলে বন্দি হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। এমনকি দ্বিতীয় ভিসির নামে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগের মামলা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। বর্তমান ভিসির সময়ে ক্যাম্পাসে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। ক্যাম্পাসকে সেশনজটমুক্ত করার বিশেষ কর্মকাণ্ড হয়েছে গত এক বছর। সেকারণে সেশনজট থেকে অনেকাংশেই রেহাই পেয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ যমুনা নিউজকে জানান, গত বছর ২১ জুন ভিসি হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর সেশনজট কমাতেই মূলত আমি কার্যক্রম শুরু করি। গত একবছরে বিভিন্নভাবে ৪-৫ বছরের সেশনজটে পড়া শিক্ষার্থীদের দিনরাত ১ হাজার ১৩০টি পরীক্ষা গ্রহণ করি। রাত-দিন ক্লাস নিয়েছি শিক্ষার্থীদের। ফলে এখন সেশনজট মুক্ত হওয়ার পথে। এ বছরই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সেশনটজট মুক্ত ঘোষণা করতে পারবো ইনশাআল্লাহ। তিনি বলেন শিক্ষা গবেষণাসহ সার্বিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা জবাবদিহি নিশ্চিতে মাধ্যমে একটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আমরা সবাই মিলে কাজ করছি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী যমুনাকে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ১৩ বছর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যে অরাজক পরিস্থিতি ছিল, তাতে আমরা ব্যথিত হয়েছি। দুঃখ পেয়েছি। কষ্ট পেয়েছি। বছরখানেক হলো ক্যাম্পাসে যে স্থিতিশীলতা এসেছে সেটি ধরে রাখার দায়িত্ব ভিসিসহ সংশ্লিষ্ট সকলের। আমরা চাই প্রতিষ্ঠার যে উদ্দেশ্য ছিল, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হলো এটি হবে শিক্ষা ও গবেষণার একটি ‘সেন্টার ফর এক্সিলেন্ট’ সেটি সামনের দিনগুলোতে আমরা দেখতে পাবো।