দক্ষিণ কোরিয়ার উলসান শহরে এনজিইউ ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প খাতে প্রতিবছর কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মী সরকারিভাবে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এ বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ১৭০ বাংলাদেশি কর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় গেছেন। আগামী তিন মাসে আরও প্রায় দুই হাজার কর্মী যাওয়ার সুযোগ পাবেন। দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শুধু কোরিয়ান ভাষা শিখলে নামমাত্র খরচে মাসে দেড় লাখ টাকার বেশি বেতনে চাকরি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়া যায়।
দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ২০০৭ সালে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতে ২০০৮ সাল থেকে দেশটিতে দক্ষ কর্মী পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস অব কোরিয়া (এইচআরডি কোরিয়া) কর্মী পাঠানোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেমের (ইপিএস) আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প খাতে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো হয়। কয়েক ধাপে প্রার্থী নির্বাচনের পর দক্ষ কর্মীরা সেখানে যাওয়ার সুযোগ পান। বোয়েসেলের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়া গেছেন ২৫ হাজার ২১৪ জন বাংলাদেশি কর্মী। এর মধ্যে ৭৬ জন নারী। এ বছর প্রায় ৫ হাজার কর্মী যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আগামী বছর ৩ থেকে ৪ হাজার বাংলাদেশি কর্মী দক্ষিণ কোরিয়া যেতে পারবেন বলে আশা করছে বোয়েসেল।
দক্ষিণ কোরিয়া যেতে আগ্রহী কর্মীদের কমপক্ষে এসএসসি পাস হতে হবে। বয়স ১৮ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে। পাসপোর্ট থাকতে হবে। এ ছাড়া কোরিয়ান ভাষা জানতে হবে এবং কোরিয়ান ভাষা পরীক্ষায় পাস করতে হবে।
নূর আহমেদ, বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক
দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার যোগ্যতা
বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক নূর আহমেদ বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া যেতে আগ্রহী কর্মীদের কমপক্ষে এসএসসি পাস হতে হবে। বয়স ১৮ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে। পাসপোর্ট থাকতে হবে। এ ছাড়া কোরিয়ান ভাষা জানতে হবে এবং কোরিয়ান ভাষা পরীক্ষায় পাস করতে হবে। ফৌজদারি অপরাধে জেল বা অন্য কোনো শাস্তি হলে আবেদন করতে পারবেন না। কালার ভিশনে সমস্যা থাকা যাবে না।
অনলাইনে নিবন্ধন
সরকারিভাবে দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী পাঠানোর জন্য কয়েক ধাপে প্রার্থী নির্বাচন করে বোয়েসেল। প্রথমে প্রার্থীদের অনলাইনে এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে হয়। প্রতিবছর সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাসে নিবন্ধন শুরু হয়। এ বছরের নিবন্ধন ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এইচআরডি কোরিয়ার চাহিদা অনুযায়ী, এবার মোট ২৪ হাজার প্রার্থী কোরিয়ান ভাষা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন। এর মধ্যে কোরিয়ান ভাষা জানা ৯ হাজার এবং ভাষা না জানা ১৫ হাজার প্রার্থী পরীক্ষা দিতে পারবেন।
নিবন্ধন করা প্রার্থীদের প্রথম ধাপের পরীক্ষা ২১ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর এবং দ্বিতীয় ধাপে আগামী ১১ থেকে ১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে। কোরিয়ান ভাষা না জানা নিবন্ধন করা প্রার্থীর সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি হলে লটারির মাধ্যমে কোরিয়ান ভাষা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে। লটারি–সংক্রান্ত কার্যক্রম আগামী রোববার বোয়েসেলের কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত হবে। আগ্রহী প্রার্থীদের লটারির সময় উপস্থিত থাকতে হবে। উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা বোয়েসেলের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হবে।
বাছাইপ্রক্রিয়া
বোয়েসেল থেকে জানানো হয়, অনলাইনে নিবন্ধন করার পর যাঁরা কোরিয়ান ভাষা জানেন না, তাঁরা কোরিয়ান ভাষা শেখার সময় পান। সরকারিভাবে সারা দেশে ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে কোরিয়ান ভাষা শেখানো হয়। এরপর এইচআরডি কোরিয়া তাঁদের ২০০ নম্বরের পরীক্ষা নেয়। এর মধ্যে রিডিং ১০০ এবং লিসেনিং ১০০। পরীক্ষার সময় ৫০ মিনিট। ২০০ নম্বরের মধ্যে ১১০ নম্বরের বেশি প্রাপ্ত প্রার্থীদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ নম্বরের ক্রম অনুযায়ী মেধাতালিকা তৈরি করা হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরাই শুধু ইপিএসের অধীন চাকরির আবেদনপত্র জমা দিতে পারেন।
যেতে খরচ
বোয়েসেলের উপমহাব্যবস্থাপক নূর আহমেদ বলেন, এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেমের (ইপিএস) আওতায় দক্ষিণ কোরিয়া যেতে একজন বাংলাদেশি কর্মীর সব মিলে ৩৩ হাজার ৫২৪ টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে বোয়েসেলের সার্ভিস চার্জ ভ্যাটসহ ২৩ হাজার ১৮৪ টাকা, নিবন্ধন ফি ২০০, ম্যানপাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের জন্যকল্যাণ তহবিল ফি ৩ হাজার ৫০০, ট্যাক্স ৮০০, স্মার্ট কার্ড ফি ২৫০, বিমা ফি ৪৯০ এবং ভিসা ফি ৫ হাজার ১০০ টাকা। তবে যাওয়া–আসার বিমানের টিকিটের ব্যয় কর্মীকে বহন করতে হয়।
যেসব খাতে চাকরির সুযোগ
বোয়েসেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (আইটি অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) মো. নূরুল ইসলাম বলেন, মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার উৎপাদন খাতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে পনির ও খাদ্যপণ্যশিল্প, কাগজশিল্প, প্লাস্টিকশিল্প, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস শিল্প, কাঠশিল্প, মেটালশিল্প, মেশিনারিজ, টেক্সটাইল ও পোশাকশিল্প।
সুযোগ-সুবিধা
দক্ষিণ কোরিয়ার অ্যালকো স্টিলে সহকারী হিসেবে কর্মরত নাহিদ নাদিম বলেন, দক্ষিণ কোরিয়াতে ওভার টাইমসহ কাজ করলে মাসে তিন লাখ টাকাও আয় করা সম্ভব। বাংলাদেশি কর্মীদের একজনের ন্যূনতম মাসিক আয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ করতে হয়। শনি ও রোববার সাপ্তাহিক ছুটি। যাঁরা এই দুই দিন কাজ করেন, তাঁরা ওভারটাইম পান। এ ছাড়া সরকারি ছুটির দিনগুলোতে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সে সময় কেউ কাজ করলে তখনো ওভারটাইম পান। এ ছাড়া থাকা ফ্রি ও খাওয়ার জন্য কোম্পানি বেতনের বাইরে টাকা দেয়।
বিস্তারিত জানতে
সরকারিভাবে স্বল্প খরচে দক্ষিণ কোরিয়া যেতে আরও বিস্তারিত তথ্য জানতে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন বোয়েসেলের ইপিএস শাখায়। ঠিকানা: বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল), ৭১-৭২ ইস্কাটন গার্ডেন, প্রবাসী কল্যাণ ভবন (৪র্থ তলা) রমনা, ঢাকা-১০০০। ফোন: ৪৮৩১৯১২৫, ৪৮৩১৭৫১৫, ৫৮৩১১৮৩৮। ওয়েবসাইট: www.boesl.gov.bd।
‘কোরিয়ানদের কাছে বাংলাদেশি কর্মীরা বেশি পছন্দের’
এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস) কর্মসূচির আওতায় মো. নাহিদ নাদিম ২০১৫ সালে চাকরি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া যান। সেখানে ৪ বছর ১০ মাস সুনামের সঙ্গে কাজ করার পর ২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে আসেন। এরপর আবার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ পান। বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার হোয়াসংসিতে অ্যালকো স্টিল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসেবে কর্মরত। প্রথমবার যখন কোরিয়া যান তখনো এই কোম্পানিতে চাকরি করেছিলেন তিনি।
মো. নাহিদ নাদিম বলেন, ইপিএস কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন উজবেকিস্তানসহ বিশ্বের ১৫টি দেশ থেকে কর্মী নিয়ে থাকে দক্ষিণ কোরিয়া। এর মধ্যে কোরিয়ানদের কাছে বাংলাদেশি কর্মীদের সুনাম রয়েছে। কারণ, অন্যদের তুলনায় বাংলাদেশি কর্মীদের কোরিয়ান ভাষা দক্ষতা ভালো। তাঁরা সহজেই কোরিয়ানদের কথা বুঝতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, অন্যান্য দেশের কর্মীরা কোম্পানি বেশি পরিবর্তন করেন। এ জন্য কোরিয়ানরা তাঁদের কম পছন্দ করেন। বাংলাদেশি কর্মীরা দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠানে সুনামের সঙ্গে কাজ করেন, তাই বাংলাদেশি কর্মীদের নিতে তাঁরা আগ্রহী বেশি।
মো. নাহিদ নাদিম বলেন, কোরিয়ানদের ব্যবহার অনেক ভালো। তাঁরা কর্মীদের প্রতি যত্নশীল। থাকার পরিবেশ পরিচ্ছন্ন। ইপিএসের আওতায় যাঁরা দক্ষিণ কোরিয়ায় আসতে চান, তাঁদের শুধু কোরিয়ান শিখলেই হয়। অন্য কোনো কাজের অভিজ্ঞতা তেমন লাগে না। কোরিয়ানদের কাছে নিরাপত্তা আগে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজ কর্মীদের দিয়ে করানো হয় না। যেসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হয়, সেসব কাজ মেশিন দিয়ে করা হয়।