অভাবের তাড়নায় এক পাহাড়ি মা তাঁর নাড়িছেঁড়া বুকের ধনকে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে গেছেন!
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে এর চেয়ে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ আর কী হতে পারে! আমরা সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘হে মহাজীবন’ কবিতার দুটি লাইন প্রায় সময়ই আওড়াই, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী–গদ্যময়/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি।’ কিন্তু যে মায়ের পেটে ক্ষুধার রাজ্য সর্বদা বিরাজমান; তিনি কতটা অসহায় ও নিরুপায় হলে নিজের সন্তানকে বাজারে সবজি–পণ্যের মতন বিক্রি করতে চান, সেটাই আমাদের মনে এসে বারবার টোকা দিয়ে যাচ্ছে!
আমরা এক দশক ধরে কেবল উন্নয়নের বাহাস শুনে যাচ্ছি। কিন্তু ‘উন্নয়ন’ কি কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নেই আটকে থাকবে? অবকাঠামোগত উন্নয়ন চক্ষুগোচর হয় বলে আমরা সহজে উন্নয়নের সুখ অবগাহন করি। কিন্তু একজন প্রান্তিক বা খেটে–খাওয়া মানুষের ঘরের চুলায় হাঁড়ি উঠল কি না কিংবা প্রতিদিনকার ব্যস্ত মানুষের অন্তরে কী বয়ে যাচ্ছে, সেটার ধার ধারার কেউ নেই! মানসিক স্বাস্থ্যেরও যে যত্ন নিতে হয়, সে বোধও তো এখনো সমাজ, পরিবার ও কাছের মানুষ পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেনি। এ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সরকারিভাবে নেই কোনো প্রচার–প্রচারণা। দিনের পর দিন ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অসমতা, বৈষম্য, বঞ্চনা যখন একজন মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলে, তখন তারা মানসিক সমস্যা বা বিষণ্নতায় ভোগে। আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাগুলোই আমাদের দেশের মানুষের মানসিক রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে। এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে তিন কোটি মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
এমন অস্থির এই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে উন্নয়নের রঙিন চশমা দিয়ে দেশের জনগণকে এক কাতারে মাপলে সেই পরিমাপে স্বাভাবিকভাবে গরমিল হবেই। সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজের অগ্রগতি পরিদর্শন করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন মন্তব্য করেছেন, বৈশ্বিক মন্দায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অনেক সুখে আছে, বেহেশতে আছে। মন্ত্রী মহোদয় যখন উন্নয়নের এ বাহাস করছেন, তখন পাহাড়ের এক দুঃখিনী মা পেটের জ্বালায় নিজের ছেলেকে বাজারে বিক্রি করতে বসে গেছেন! কারণ, দুঃখিনী মায়ের হাতে বেহেশতের একমাত্র চাবিকাঠি এ ‘শিশুসন্তান’, যার এখনো পৃথিবীর রস–রূপ উপলব্ধি করার বোধ তৈরি হয়নি! কিন্তু ক্ষুধার জ্বালা শিশুটিও এই অবোধকালে বুঝে গেছে হাড়ে হাড়ে!
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বয়ান থেকে এও জানা যায়, সরকার আশাবাদী, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে ভারত ও চীনের মতন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। কিন্তু ‘সবকিছু ঠিকঠাক’–এর মধ্যে দুঃখিনী মায়েদের দুঃখগাথা চিরদিনের জন্য যে অতলে হারিয়ে যাচ্ছে, সে খবর রাখে কজনা!
নিজের নাড়িছেঁড়া সন্তানকে বিক্রি করতে চাওয়া অভাবী পাহাড়ি মা কিংবা পেটের দায়ে কোলের সন্তান বিক্রি করতে চাওয়া কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভার নওদাপাড়ার আয়েশারা জানেন না, ‘উত্তম, মধ্যম বা অধম আয়ের দেশ’–এর মানেটা কী? তাঁদের কাছে ক্ষুধার জ্বালা কীভাবে মিটবে, সেটাই নিত্যদিনের মন্ত্র। মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাওয়া এ দেশে যখন সুদের কারবারি সুদ উশুলের জন্য গ্রহীতার এক দিন বয়সী নবজাতককে বিক্রি করে সুদ উশুল করে কিংবা সারা জীবন নির্মমতা ও বঞ্চনার শিকার চা–বাগানের শ্রমিকেরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে আর নিজের জীবনের গতি মেলাতে না পেরে রাস্তায় নেমে এসে দৈনিক মাত্র ৩০০ টাকা মজুরি দাবি করেন, তারপরও কি আমরা বলব, দেশ আজ ভালো আছে? দেশের মানুষ বেহেশতের মতন পরম সুখে দিনাতিপাত করছে! চারদিকে এসব উন্নয়নের রঙিন বাহাস শুনে তখন আমাদের ওপর যেন বোবা কান্না ভর করে বসে!
দেশের মানুষ বন্যায় ডুবছে, অনাবৃষ্টিতে আবাদ বন্ধ, তাতে কী! ডিজেল–পেট্রলের দাম বাড়াতে হবে বিশ্ব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে! বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার যখন প্রাইভেট কারের ওপর এসে পড়ে এবং ঘটনাস্থলেই পাঁচজন মারা যান, তখন আমরা উন্নয়নের সূচককে বুঝতে পারি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কী পরিমাণ দায়িত্বজ্ঞানহীন যে একটি ব্যস্ত রাস্তায় কোনো রকম সুরক্ষাব্যবস্থা না করেই উন্নয়নের কাজ করছে। এ দেশে দ্রব্যের দাম বাড়ে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে, গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ে, শুধু সাধারণ মানুষের জীবনের দাম আর বাড়ে না!
চা–বাগানের শ্রমিকদের ওপর দীর্ঘদিনের বঞ্চনা–নির্মমতার ইতিহাস কারও অজানা নয়। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তাঁরা ১৩০ টাকা দৈনিক মজুরির পরিবর্তে ৩০০ টাকা দাবি করছেন। যুগ যুগ ধরে চা–বাগানের শ্রমিকদের দাসশ্রমে বাধ্য করে বাগানমালিকেরা মুনাফা লুটে নিচ্ছেন, এতে কারও মনে কোনো প্রশ্ন তৈরি হয় না। অথচ যাঁরা শহরে আয়েশি যাপন করেন, তাঁদের জন্য সকালে ধোঁয়া–ওঠা এক কাপ চা কিংবা বৃষ্টিবাদলের দিনে কফি শপে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বাইরের রিনিঝিনি বৃষ্টি দেখা যেন বিলাসিতার চরম সুখ! অথচ সেই এক কাপ চা তৈরিতে শ্রমিকদের রক্ত পানি করা শ্রম জড়িয়ে আছে। একই রকম বঞ্চনা ও বৈষম্য দেখা যায় পোশাকশ্রমিকদের ক্ষেত্রেও। ন্যায্য দাবিতে পোশাকশ্রমিকেরা রাস্তায় নেমে এলে মালিকশ্রেণির পেটোয়া বাহিনী প্রথমে তাঁদের ওপর হামলা করে। এতেও কাজ না হলে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পুলিশ ও আনসার দিয়ে তাঁদের থামিয়ে দেওয়া হয়।
তাই উন্নয়নের বাহাস বলুন আর মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার খুশির নাচন বলুন, দেশ আগে ঠিক করতে হবে। পাহাড়ি মায়ের পেটে আগে ভাত জোগান, আয়েশার দুধের শিশুর খাবার নিশ্চিত করুন, চা–বাগানের শ্রমিকদের ন্যায্যতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁদের ন্যূনতম নাগরিক–সুবিধা নিশ্চিত করুন, তবেই দেশ এগোবে। নয়তো ফ্লাইওভার কিংবা মেট্রোরেলের গার্ডারের নিচে মানুষ আর বেশি দিন জীবন দেবে না। দেশের মানুষের বৃহৎ একটি অংশকে পেছনে ফেলে রেখে উন্নয়ন করতে গেলে সে উন্নয়ন বেশি দিন টেকসই হবে না।