ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে থাকতে হলে মানতে হবে ছাত্রলীগের নির্দেশনা। যেখানে বলা হয়েছে, হলে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠন যেমন: ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বাম সংগঠন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের দ্বিতীয় বর্ষের নেতাকর্মীরা হলে থাকার জন্য ১৪ টি নির্দেশনা তৈরি করেছে। গত ১৮ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মেফতাহুল মারুফ কে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করার পর বাকি শিক্ষার্থীদের কে চাপে রাখতে এসব নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে বলে জানান হলের আবাসিক ছাত্ররা।
এসব নির্দেশনা গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভাইরাল হওয়ার পর পুরো ক্যাম্পাসে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রলীগের এসব নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া হলে থাকতে হলে ১৪টি নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। হলের আবাসিক ছাত্ররা এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চায় নি।
১৪টি নির্দেশনা হলো:
১. হলের ভেতরে ও বাইরে ফার্স্ট ইয়ার ব্যতীত সকল বড় ভাইদের সালাম দিতে হবে। সালাম দেওয়ার সময় ডান হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করতে হবে, হ্যান্ডশেক করার সময় বাম হাত পেছনে রাখতে হবে। হাতে ঝাকি বা চাপ দেওয়া যাবে না। হাত বুকে রাখা যাবে না।
২. মসজিদ, টিভি রুম, রিডিং রুম, বাথ-রুম, ক্যানটিন, ওয়াইফাই জোন, মেস এবং সেলুনে সালাম দেওয়া যাবে না।
৩. একসাথে অনেক বড় ভাই থাকলে চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী সালাম দিতে হবে।
৪. প্রত্যেক বড় ভাই এবং ইয়ারমেটের ফোন নাম্বার রাখতে হবে।
৫. ছাত্রলীগের সকল প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হবে। সমস্যা থাকলে ইমিডিয়েট বড় ভাইদের বলতে হবে।
৬. গেস্টরুমে লুঙ্গি, টাউজার, টি-শার্ট ও মোবাইল প্যান্ট পড়ে আসা যাবে না।
৭. ক্যান্টিনের প্রথম চারটি টেবিলে বসা যাবে না এবং ক্যান্টিন বয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।
৮. টিভি রুমের প্রথম সারির চেয়ারগুলোতে বসা যাবে না ও রিমোট হাতে নেওয়া যাবে না।
৯. চেইন অব কমান্ড মানতে হবে। বড় ভাইদের অনুমতি ব্যতীত কোনো রুমে যাওয়া যাবে না।
১০. বড় রিডিং রুম ব্যবহার করতে হবে, কোনো ভাবেই হল সংসদের রুমে প্রবেশ করা যাবে না।
১১. হলে সিগারেট খাওয়া যাবে না, রুমে খাওয়ার পরিবেশ থাকলে খাওয়া যাবে।
১২. হলে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠন যেমন: ছাত্রদল, ছাত্রশিবির এবং বাম সংগঠন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
১৩. ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১৪. সর্বোপরি হলের যেকোনো ব্যাপারে ইমিডিয়েট বড় ভাইদের সিন্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
জিয়া হলের আবাসিক ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বললে তাদের কে হল থেকে বের করে দিবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আবাসিক শিক্ষার্থী হলের সামনে কথা বলতে রাজি হয় নাই।
এই বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মোজাম্মেল হক বলেন, “ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব, আবাসন সংকট নিরসনে স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ না নেওয়া, হল প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও শিক্ষার্থী বান্ধব না হওয়াতে হলে থাকা সকল শিক্ষার্থীই ছাত্রলীগের জিম্মি। শিক্ষার্থীদেরকে আনুগত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে, তাদের কে মিছিলে যেতে বাধ্য করতে সবসময় ভীতির পরিবেশ বজায় রাখে, গেস্টরুম সংস্কৃতির মাধ্যমে এসব Code Of Conduct চালু রাখে। যারা এসব Manner মানতে চায় না বা তাদের প্রোগ্রামে অনুপস্থিত থাকে, গেস্টরুমে অনুপস্থিত থাকে, আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ঘাটতি দেখায় তাদের ”শিবির”, “জঙ্গি”, “রাষ্ট্রদ্রোহী” ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। এমনকি কখনোও কখনোও হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এক্ষেত্রে প্রশাসন সবসময়ই নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৮ আগস্ট মধ্যরাতে মারুফকে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামের সমালোচনা করায় জঙ্গি সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে জিয়া হলের প্রভোস্ট পুলিশের হাতে সোপর্দ করে।”
তিনি দাবি করেন, “দখলদারিত্ব ও ভীতির পরিবেশ সৃষ্টির বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারা এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ জিয়া হলের প্রভোস্টকে অপসারণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
তিনি ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সকল ছাত্র সংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীকে গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস এবং শিক্ষা উপযোগী হল নিশ্চিতের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে সংযুক্ত ,যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের ছাত্র এবং ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে প্রতিধ্বনিতাকারী ছাত্রনেতা মোঃ মাহমুদুল হাসান জানান,”জিয়া হলে যখন আমরা ২০১৭ সালে উঠতে গিয়েছি, তখনই এ ধরনের নিয়মাবলি সম্বলিত পোস্টার প্রথম বর্ষের গণরুমে টাঙানো দেখেছি।
ভিন্ন রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কারণে আমি আর সেসময়ে হলে থাকতে পারিনি। সেসময়েই আমি প্রথম গণরুমের অমানুষিক জীবনযাপন ও গেস্টরুমে ছাত্রলীগের নির্যাতনের সাথে পরিচিত হই।
তিনি আরো জানান, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কিছু নয়। এ নিয়ম শুধু জিয়া হলেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে কার্যকর। জোর করে হলের সকল শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগ করতে বাধ্যই করে না শুধু, এমনকি পরীক্ষার আগের দিনেও জোর করে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে নিয়ে যাওয়া এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে সাধারণ বিষয়।
তিনি আরো বলেন, হলের অভিভাবক প্রভোস্টরা দলদাসের ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছাত্রলীগের নির্যাতনকে রোধ করাতো দূরের কথা, বরং কখনো নীরব দর্শক আবার কখনো বা নির্যাতিত শিক্ষার্থীকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে সহায়তা করেন।
ছাত্রলীগ ও হল শিক্ষকদের এই সম্মিলিত নির্যাতনকে এখনই বন্ধ করতে হবে। নয়তো হাজারো মেধার কান্ডারীরা জোর করে মিছিলে নেয়ার সংস্কৃতির তলে চাপা পড়ে থাকবে চিরকাল।
এই বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি হাসিবুল ইসলাম শান্ত এর সাথে কথা বলার জন্য হলে গিয়ে দেখা পাওয়া যায় নি। পরে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ ভুয়া। গত দুই দিন ধরে হলের একটা ঝামেলায় ছাত্রলীগকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করছে একটি মহল। তারাই এটা লিখে দিয়েছে। গত সাড়ে তিন/চার বছর ধরে আমরা “মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল” নামে এই হলের নাম লিখি না। সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগে এই নামে কোন ইউনিট নাই। আমরা শুধু মাত্র “মুক্তিযোদ্ধা হল” নাম ব্যবহার করে থাকি। তারা এতটাই বোকা যে “জিয়া হল ছাত্রলীগ ” নামে একটা ভুয়া জিনিস বের করেছে।
ছাত্র অধিকার পরিষদের নাম নেই: নির্দেশনায়
হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও বাম সংগঠন এর নাম উল্লেখ করে এসব সংগঠনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিলেও হলেও ছাত্র অধিকার পরিষদের নাম মেনশন করা নেই।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সন্দেহ এই কাজটি ছাত্র অধিকার পরিষদের লোকজন করতে পারে। তাই তাদের সংগঠনের নাম উল্লেখ করা হয়নি বলেও অভিযোগ তাদের।
এই বিষয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এবং ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক আখতার হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ডঃ মোঃ বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে তিনি এসব বিষয়ে জানেন না বলে মন্তব্য করেন।