রক্তস্নাত ২১শে আগস্ট আজ। বারুদ আর রক্তমাখা বিভীষিকাময় রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের দিন। নারকীয় গ্রেনেড হামলার ১৮তম বার্ষিকী। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের এই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে নজিরবিহীন এক নারকীয় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত পৈশাচিক এই হামলায় সেদিন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী বেগম আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীসহ অনেক সাধারণ মানুষ।
সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মানববর্ম তৈরি করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। শুধু গ্রেনেড হামলাই নয়, সেদিন তাদের প্রধান টার্গেটে থাকা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার গাড়ি লক্ষ্য করেও চালানো হয় ছয় রাউন্ড গুলি। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও আহত হন, তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার পর চার নেতাকেও ষড়যন্ত্র করে কারাগারে হত্যা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্পেশালাইজড মারণাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেডের বিস্ফারণ ঘটানো হয়।’
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পেছনে ছিলেন তৎকালীন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, দেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা, কয়েক জন শীর্ষ জঙ্গি আর পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্হা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের মতোই ২১ আগস্টের হামলার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হয়েছিল। ঐ সময়ের কিছু সামরিক কর্মকর্তা আর জঙ্গি নেতাদের নিয়ে হাওয়া ভবনে বসে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আশ্বাসে সবকিছু চূড়ান্ত করা হয়। হামলায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের পাকিস্তানে ট্রেনিং দেওয়া হয়। ট্রেনিংয়ের পর তাদের আর্জেস গ্রেনেডও সরবরাহ করে দেশটি। আর হামলা শেষে পাকিস্তান ঘাতকদের আশ্রয়ও দেয়।
১৮ বছর আগে ২০০৪ সালের এই দিনে মুহুর্মুহু গ্রেনেডের বিকট বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। মানুষের আর্তনাদ আর কাতর ছোটাছুটিতে সেখানে তৈরি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্হিতি। আহতদের অনেকেই এখনো শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছেন। অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। স্প্লিন্টারের আঘাতে কেউ হারিয়েছেন চোখ, কারো গেছে চলার ক্ষমতা, কেউ হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি। অনেকে প্যারালাইজড হয়ে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করছেন, অনেকের জীবনে এখন ক্র্যাচই চলাফেরার নিত্যসঙ্গী। আবার কারো সারা জীবনের সঙ্গী হয়েছে অসহ্য যন্ত্রণা। এত বছর পরও স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না তারা। সেদিনের পরে আহতদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। কেউ কেউ শরীরে বহন করে চলেছেন শত শত স্প্লিন্টার।
পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকার কথা জানালেন ঐ হামলায় আহত মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ও জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নাসিমা ফেরদৌসী। তিনি বলেন, ‘পঙ্গুত্বের জীবন যে কী কষ্টের, কী যে ভয়াবহ, সে কথা পঙ্গু না হলে বোঝা যায় না। আমার সুন্দর জীবনটা হারিয়ে গেছে। জোড়াতালি দেওয়া হাত-পা নিয়ে বেঁচে আছি। মাথা, বুক, দুই পা, পেটসহ সর্বাঙ্গে বিঁধে আছে অসংখ্য স্প্লিন্টার। অনেকটা মৃতু্যর সঙ্গে যুদ্ধ করে চলছি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমও গ্রেনেড হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। দেশে-বিদেশে চিকিত্সার পর এখনো তার সর্বাঙ্গে অসংখ্য স্প্লিন্টার বিঁধে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়েই আমার দিন কাটছে। অমাবস্যা ও শীতকাল এলে যন্ত্রণা আরো বেড়ে যায়।’
বর্বরোচিত সেই গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন। তিনি বলেন, এখনো ১০ থেকে ১২টি স্প্লিন্টার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ১ হাজার ৮০০ স্প্লিন্টার দেহের মধ্যে নিয়ে বেঁচে আছেন মাহবুবা পারভীন। তিনি জানান, মাথার দুটি স্প্লিন্টার তাকে খুব জ্বালায়। সুঁইয়ের মতো হুল ফোটায়। আহতদের একজন বর্তমান ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, কিডনি, অণ্ডকোষ, রক্তনালিসহ তার শরীরের বিভিন্ন স্হানে এখনো ৫৮টি স্প্লিন্টার রয়েছে। হামলায় আহত হন আওয়ামী লীগের তত্কালীন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মুক্তি মামুন। স্প্লিন্টারের বিষক্রিয়ায় দিনদিন তার শরীরে নানা রোগের উগসর্গ দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিত্সা নেওয়ার পরও সুস্হ হতে পারেননি। একপ্রকার পরিবারের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি: গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে আজ সকাল ১০টায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হবে। সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে নিহতদের স্মরণে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করবেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের জন্য সর্বস্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।