১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার। তাদের একটি অংশ অপুষ্ট, ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম। অন্য অংশটি স্থূল অর্থাৎ তাদের ওজন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি।
১৬ আগস্ট আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি), ইউএসএআইডি এবং ডেটা ফর ইমপ্যাক্ট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেশের নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে এ তথ্য তুলে ধরে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি বিবাহিত নারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ।
তাদের মধ্যে ৫০ লাখ নারীর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম অর্থাৎ তারা অপুষ্টিতে ভুগছেন। অন্যদিকে ১ কোটি ২০ লাখ নারীর ওজন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থাৎ তারা স্থূলকায়। অপুষ্টির কারণেই তারা স্থূল। এর অর্থ হচ্ছে ওই বয়সি ৪৫ শতাংশ নারী অপুষ্টিতে ভুগছেন। দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির এ ভয়াবহ চিত্র বুঝিয়ে দিয়েছে নারীদের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা কতটা পিছিয়ে আছি।
কম ওজন এবং বেশি ওজন বা স্থূলতা যখন একই সঙ্গে কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রে থাকে তখন এটাকে অপুষ্টির দ্বি-মুখী সংকট (Double Burden of Malnutrition) বলা হয়। এর সঙ্গে অনুপুষ্টির অভাবজনিত সমস্যা যোগ হলে অপুষ্টির ত্রি-মুখী সংকট (Triple Burden of Malnutrition) সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০১৮ রিপোর্টটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বিবাহিত নারীদের মধ্যে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি উলেখযোগ্য হারে কমেছে (যা ২০০৭ সালে ৩০ ভাগ এবং ২০১৭-১৮ সালে প্রায় ১৩ ভাগ)।
অন্যদিকে, স্থূলকায় নারীদের সংখ্যা ২০০৭ সালে ১২ ভাগ থেকে ২০১৭-১৮ সালে ৩২ ভাগ হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি কমলেও সার্বিকভাবে স্থূলতা পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। উল্লেখ্য, গ্রামাঞ্চলে নারীদের মাঝে ওজন স্বল্পতাজনিত অপুষ্টি বেশি, অন্যদিকে শহরে স্থূলকায় নারীর সংখ্যা বেশি।
কম ওজন এবং স্থ‚লতা উভয়ের সঙ্গেই রক্তস্বল্পতার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে, সারা বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে আয়রন-ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতার প্রকোপ অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, এ দেশের ৩৭ শতাংশ প্রজননক্ষম নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। এ রক্তস্বল্পতা গর্ভপাত, অকাল জরাম ও কম জন্ম ওজনের শিশু জন্মদানের ঝুঁকি বাড়ায়। শিশুদের বৃদ্ধি ও মেধা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। রক্তস্বল্পতা চরম ক্লান্তি সৃষ্টি করে, কার্যক্ষমতা হ্রাস করে এবং অসুস্থ স্বাস্থ্যের বোঝাকে বাড়িয়ে তোলে। সর্বোপরি জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।
২০১৯-২০ জাতীয় অনুপুষ্টি জরিপে (ন্যাশনাল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট সার্ভে) বাংলাদেশে ৩০ ভাগ প্রজননক্ষম নারীদের মাঝে আয়োডিনের ঘাটতি পাওয়া গেছে। আয়োডিনের অভাবে থাইরয়েডের বিভিন্ন রকম সমস্যা এবং শিশুদের মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ৯ দশমিক ৭ ভাগ প্রজননক্ষম নারীদের মাঝে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাব রয়েছে। অপর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না।
গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতার জন্যও দায়ী। এ ছাড়াও এদেশের নারীরা অন্যান্য অনেক অনুপুষ্টি উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, জিংক ইত্যাদির ঘাটতিতে ভুগছেন। সব মিলিয়ে বাংলদেশে এখন অপুষ্টির ত্রিমুখী সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, যার ফলে অনেক পরিবারেই পর্যাপ্ত খাদ্যের সংকুলান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এতে, বিশেষ করে নারী ও শিশুরা তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা অপুষ্টির সমস্যাকে আরও প্রকট করতে পারে।
অপুষ্টি নামক অভিশাপের পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও অধিকাংশ মানুষই পুষ্টি বিষয়ে সচেতন নয়। পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে মা ও শিশুদের সঠিক পুষ্টি ও যত্ম নিশ্চিত হচ্ছে না। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের নারীরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না, আবার সামাজিক নানা বৈষম্যের কারণে এখনো নারীরা বাড়ির সবার শেষে খাবার খায় বা খাবারের ভালো অংশটুকু পরিবার প্রধানকে দেয়। ফলে একজন নারী পর্যাপ্ত পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয় এবং অপুষ্টিতে ভোগে।
পাশাপাশি, প্রতিদিন যে খাদ্যবৈচিত্র্য মেনে খাবার খাওয়া উচিত তা খুব কম মানুষই মেনে চলে। অন্যদিকে, আরেক শ্রেণির মানুষ আছে যারা ফাস্টফুড, প্রক্রিয়াজাতকৃত ও রেস্টুরেন্টের খাবার অনেক পছন্দ করে। অধিক তেল/চর্বিসমৃদ্ধ ও শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমায়, যা দীর্ঘমেয়াদে ওজন বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে।
বিশ্বায়নের এ যুগে মানুষ এখন শহরমুখী, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে অল্প দূরত্বেও হাঁটতে চায় না। ব্যস্ততা বা অলসতার কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করাও হয়ে ওঠে না। প্রতিদিনকার খাদ্যাভ্যাস, বিলাসিতা ও অলসতা স্থূলতার অন্যতম প্রধান কারণ।
অপুষ্টির অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব। সেইসঙ্গে একটি শিশুর পুষ্টি অবস্থা কেমন হবে তা তার জীবনের শুরুতেই অনেকটা নির্ধারিত হয়। গর্ভাবস্থার আগে এবং গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের অপুষ্টি শিশুর স্বাস্থ্যের উপর উলেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
অপুষ্টির অবস্থা ও কারণ যাই হোক না কেন, এর ফলাফলগুলো কিন্তু খুবই ভয়ঙ্কর ও নেতিবাচক। শৈশবকালীন অপুষ্টি শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এবং শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক বৃদ্ধি ও মেধার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। আবার, অতিরিক্ত ওজন/স্থূলতা দীর্ঘস্থায়ী অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা ইত্যাদির অন্যতম কারণ। নারীদের অতিরিক্ত ওজন কিংবা কম ওজন গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতা এবং সেইসঙ্গে গর্ভস্থ শিশুর নানা সমস্যা তৈরি করে।
আবার শৈশবকালীন অপুষ্টিতে ভুগলে পরে অধিক পুষ্টি গ্রহণ শরীরে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না। যার কারণেও স্থূলতা হতে পারে। কম ওজনের শিশুরা পরবর্তী জীবনেও অপুষ্টিসহ নানা ধরনের রোগে ভুগতে থাকে। স্থূলকায় নারীদের গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধির ঝুঁকি বেশি এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়ে থাকে যা অনেকসময় কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। নারীরা অপুষ্টিতে ভুগলে পরবর্তী প্রজন্মেরও তা চক্রাকারে চলতে থাকে। সর্বোপরি, অপুষ্টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতিতে বাধার সৃষ্টি করে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কিছু অর্জনের কথা উঠে এসেছে। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লিঙ্গসমতা, নবজাতক ও অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সি শিশুর মৃত্যুহার হ্রাস, মাতৃমৃত্যু কমানো, টিকাদানের ব্যাপ্তি বাড়ানো, সংক্রামক রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতির কথা বলা হয়েছে সেখানে।
অথচ পুষ্টিখাতে উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক নয়। এখনো বিভিন্ন বয়স শ্রেণির জনগোষ্ঠী বহুমাত্রিক অপুষ্টিতে ভুগছে। এর পেছনে নানা ফ্যাক্টর কাজ করছে।
অপুষ্টির দ্বি-মুখী বা ত্রি-মুখী সংকট উত্তরণে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বর্তমানে দ্বিতীয় জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২০২৫)-এর আলোকে দেশব্যাপী পুষ্টি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
জাতীয় পুষ্টিসেবার মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে অপুষ্টি শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা, অনুপুষ্টির সরবরাহ এবং গর্ভকালীন ও প্রসব পরবর্তী করণীয়, শিশু ও কিশোরী পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। জনগণের বৃহৎ স্বার্থে এ কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা ও জবাবদিহিতা জোরদার করা দরকার। পুষ্টি শিক্ষাকে সার্বজনীন করার জন্য স্কুল, কলেজের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং গুরুত্ব সহকারে শিক্ষার্থীদের পড়ানো ও প্রাত্যহিক জীবনে পালনে উৎসাহিত করা দরকার।
কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের নিরাপদ ও টেকসই খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার পাশাপাশি পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রমকে বেগবান করা। সব সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমে পুষ্টির বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব দেওয়া, তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বেশি বেশি পুষ্টি বিষয়ক প্রচারণা; ধর্মীয় নেতা যেমন মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে প্রচারণা চালানো দরকার।
সেইসঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ইন্ডাস্ট্রি/ বেকারি/ কোম্পানি/ ফার্মগুলোর কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করা দরকার। যাতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার প্রস্তুত ও সরবরাহের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যের ইতিবাচক পরিবর্তনে সহায়ক হয়। সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের কার্যক্রমে কমপুষ্টির পাশাপাশি অতিপুষ্টি নিয়েও ভাবতে হবে। আরও অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
সেইসঙ্গে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে সরকারের বিশেষ পরিকল্পনা থাকতে হবে। যাতে তারা দ্রুত ভালো অবস্থায় আসতে পারে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সরকারের নীতি নির্ধারণী গোষ্ঠীকে পুষ্টির উপর আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
সরকারের জাতীয় পুষ্টিসেবা কার্যক্রমসহ অন্যান্য পুষ্টি সংবেদনশীল কার্যক্রমের অংশীদার বিভিন্ন বিভাগের কাজের জন্য ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত প্রত্যেকটি জায়গায় সঠিক অংশীদারত্ব, জবাবদিহিতা ও সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে।
পুষ্টি অবস্থার উন্নয়নে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং রূপকল্প ২০৪১-এর লক্ষ্য।