ইউক্রেনের মেলিতোপোলের কাছে একটি মাঠে কৃষকেরা গম কাটছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে গম, সয়াবিন, চিনি ও ভুট্টার দাম অনেকটা চলতি বছরের শুরুর অবস্থায় ফিরেছে
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেশ কমেছে। সর্বশেষ জুলাই মাসে তার আগের মাস জুনের তুলনায় খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশেষ করে গম ও ভোজ্যতেলের দাম কমার কারণেই সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের দামে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ-সমর্থিত ইউক্রেন ও রুশ রপ্তানি চুক্তি, প্রধান উৎপাদনকারী দেশগুলোয় প্রত্যাশার চেয়ে ভালো ফলন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং মার্কিন ডলারের দাম কমা এগুলোও খাদ্যপণ্যের দরপতনে মোটামুটি ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্ববাজারে প্রধান খাদ্যপণ্যসমূহের দাম কমার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। তবে এই দরপতন অব্যাহত থাকা এবং দাম আরও কমা নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তিটিকে বিশ্লেষকেরা বেশ নড়বড়ে বলে মনে করেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুলাই মাসে খাদ্যপণ্যের দাম এর আগের মাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সংস্থাটি খাদ্যপণ্যের দাম ‘খুব উচ্চপর্যায় থেকে’ পতনকে ‘স্বাগত’ জানিয়ে বলেছে, এই সুসংবাদটি স্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এফএওর প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টোরেরো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, এখনো অনেক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সারের উচ্চ দাম, যা ভবিষ্যতের উৎপাদন সম্ভাবনা ও কৃষকদের জীবিকাকে প্রভাবিত করতে পারে। সেই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বলতা, মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা—এগুলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করে।
বৈশ্বিক পণ্যমূল্য নিয়ে এফওওর তৈরি করা খাদ্য মূল্যসূচক (এফপিআই) জুলাই মাসে আগের মাসের তুলনায় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। জুন মাসে এই সূচক মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছিল।
গত বছরের (২০২১ সাল) জুলাইয়ের তুলনায় এবার একই মাসে এফএওর খাদ্য মূল্যসূচকটি ১৩ দশমিক ১ শতাংশ বেশি দেখা গেছে।
রাবো ব্যাংকের একজন বিশ্লেষক বলেছেন, ইউক্রেনের শস্য করিডর শেষ হলে খাদ্যের দাম কিন্তু আবার বাড়তে পারে। স্বল্প মেয়াদে অবশ্য দাম আরও কমতে পারে, তবে ভবিষ্যতের কথা বলা যাচ্ছে না। গম, সয়াবিন, চিনি ও ভুট্টা প্রভৃতি খাদ্যপণ্যের দাম কমে এখন ২০২২ সালের শুরুর অবস্থায় ফিরে এসেছে। যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে গত শুক্রবার প্রতি বুশেল (প্রতি বুশেল যুক্তরাজ্যে ৩৬ দশমিক ৪ লিটার, আর যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ দশমিক ২ লিটারের সমপরিমাণ) গম ৭৭৫ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলারে বেচাকেনা হয়েছে, যা বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ছিল ৭৫৮ ডলার। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরিস্থিতিতে মার্চে প্রতি বুশেলের দাম বেড়ে ১ হাজার ২৯৪ ডলারে ওঠে।
এফএওর খাদ্য মূল্যসূচক অনুযায়ী আলোচ্য জুলাই মাসে প্রধান খাদ্যশস্যগুলোর দাম গড়ে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে বিশেষ করে গমের দাম ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। সংস্থাটির মতে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার শস্য চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় ও পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে এবার ভালো ফসল হওয়ায় গমের দাম বেশি কমেছে।
ভোজ্যতেলের বাজারে লাগাম পড়েছে পাম তেলের বৃহত্তম উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে রপ্তানি হওয়ার সুবাদে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সূর্যমুখী তেলের চাহিদা কমার কারণে ভোজ্যতেলের দাম ১৯ দশমিক ২ শতাংশ কমে গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
একদিকে চাহিদা সংকুচিত হওয়ায় অন্যদিকে প্রধান দুই উৎপাদক ও রপ্তানিকারক ব্রাজিল ও ভারত থেকে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আলোচ্য মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ৩ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। এতে চিনির দাম এখন গত পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে।
এ ছাড়া দুগ্ধপণ্য ও মাংসের দামও কমেছে। পণ্য দুটির দাম কমেছে যথাক্রমে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।
কেন দাম কমেছে
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম কমার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকদের অনেকেই চাহিদা কমা ও সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে কয়েক মাস ধরে যুদ্ধ চলার কারণে কৃষ্ণসাগর দিয়ে খাদ্যশস্য রপ্তানি বন্ধ ছিল। এ রকম অবস্থায় ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় দেশ জাতিসংঘ-সমর্থিত চুক্তি মেনে চলায়, এবার প্রত্যাশার চেয়ে ভালো ফসল হওয়ায় এবং বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম কমায় আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম কমেছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় চাহিদা কমে দামের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএসপিআর) বাজার ও বাণিজ্যবিষয়ক পরিচালক রব ভোস মনে করেন, এবার যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় গমের বাম্পার ফলন হয়েছে। উভয় দেশই এখন আন্তর্জাতিক বাজারে গম সরবরাহ করতে প্রস্তুত। সেটি হলে বিশ্ববাজারে সরবরাহ বেড়ে গমের দাম আরও কমবে। তাঁর মতে, দেশে দেশে স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে মার্কিন ডলারের দাম কমে আসাতেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। কারণ, ডলারের দাম যখন বেড়ে গিয়েছিল, তখন পণ্যের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বলা হচ্ছে, বিশ্ববাজারকে স্থিতিশীল রাখতে হলে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধও রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তির ধারাবাহিকতা সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করতে হবে। কারণ, ওই সময়েই ইউক্রেন তার বেশির ভাগ পণ্য রপ্তানি করে থাকে।
যুদ্ধের কারণে খাদ্য পরিস্থিতি নাজুকও হয়ে যেতে পারে। রাবো ব্যাংকের কৃষি ও পণ্যবাজার গবেষণার প্রধান কার্লোস মেরা বলেছেন, ‘যত দিন যুদ্ধ চলবে’ তত দিন ইউক্রেনের আবাদযোগ্য অনেক জমি ধ্বংস হতে পারে। ফলে দেশটিতে ফসলের ফলন কম হবে, যার অর্থ আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ কমবে। কার্লোস মেরা আরও বলেন, ‘শস্য রপ্তানির করিডরটি একবার শেষ হয়ে গেলে আমরা সামনে আরও দাম বাড়তে দেখতে পারি।’
মূল্যবৃদ্ধি পেলে তার পরিণতি কী হয়, সেটি ইউক্রেনের পোলট্রি খাতের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান মাইরনিভস্কি হ্লিবোপ্রোডাক্টের (এমএইচপি) নির্বাহী চেয়ারম্যান জন রিচের মুখেই শোনা যাক। তিনি সম্প্রতি সিএনবিসিকে বলেছিলেন, ক্ষুধার্ত মানুষ দিনের শেষে ক্ষুধার্তই। এক সপ্তাহ পর তারা আরও ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে।