নিজস্ব প্রতিবেদক: যখন দেশে সরকার জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জঙ্গি সম্পৃক্ততার খোঁজে মাঠে নামিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিটকে, তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসনিার দেয়া এনআরবিসি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছে একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধে দন্ডিত মৃত গোলাম আযমের জামাতা হুমায়ুন কবির। খোজ নিয়ে জানাযায় এই হুমায়ুন কবির বেসরকারী ব্যাংক এনআরবিসির ডিএমডি হিসেবে সদ্যই যোগদান করেছে। আর তাকে নিয়োগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর আর্শিবাদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল পারভেজ।
গত কয়েক বছরে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত দলটির সংশ্লিষ্ট ৫৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়। এরপরই দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকির শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট তদন্ত শুরু করে। ঠিক কণই এইসব কর্মকান্ডে বাধা দিতে থাকে ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের এক সময়ের নির্বাহী পরিচালক বর্তমানে এনআরবিসি ব্যাংকের ডিএমডি হুমায়ুন কবির।
গেলো কয়েক বছর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত-বিএনপি’র দুই শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরী) ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে তালিকা দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। পরে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে ব্যাংক-বিমাসহ যেসব সেবামূলক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াত ও শিবিরের কর্তৃত্ব রয়েছে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কারও বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু হুমায়ুন কবির দায়িত্ব থাকা অবস্থায় এইসব সিন্ধান্ত মানতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকাংশে বাধাগ্রস্থ হয়। কারন হুমায়ুন কবিরের সাথে জামাত কানেকশনের কারনে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ কোনও নাশকতা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া হুমায়ুন কবিরের মত সুবিধাভোগীর ব্যাক্তিগত তথ্যও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সুবিধাভোগীরা কোন খাতে ব্যবহার করেছেন সে বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাহী পরিচালক জানান, ইতিমধ্যেই দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সব শাখায় নজরদারি শুরু হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশেষভাবে নজরদারিতে রয়েছে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম। আর গোলাম আযমের মেয়ের জামাই হবার কারনেই হুমায়ুন কবিরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর বা গোয়েন্দা শাখা বিএফআইয়ের প্রধান করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক হুমায়ুন কবিরকে এইসব শীর্ষস্থানে পদোন্নতী দেয়নী গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই। কিন্তু এনআরবিসির তমাল পারভেজ তাকে গোলাম আযমের জামাই হবার কারনেই পুরস্কৃত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বলেন, এ বিষয়ে কাজ করছে ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআই)। বিষয়টির সঙ্গে আমরা অনেকেই সংশ্লিষ্ট নই। অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলে তদন্তের অগ্রগতি ও তদন্তের ধরন সম্পর্কে বলা ঠিক হবে না।
এ বিষয় জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গোলাম আযমের মেয়ের জাসাই কি করে এত বড় পদে আসীন হয়েছিলেন কা্র ক্ষমতাতেই বা বর্তমানে এনআরবিসি ব্যাংকের ডিএমডি হয়েছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারন কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ উঠলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে বিএফআই ইউনিট। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তারাই ফাক ফোকরগুলো জানে। তিনি বলেন, সরকার চাইলে যে কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেকোনও ধরনের বিষয় খতিয়ে দেখতে পারে।
তাছাড়া এনআর বিসি ব্যাংক হুমায়ুন কবির ছাড়াও ওবায়দুল হক নামের বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক সাবেক নির্বাহী পরিচালককে এনআরবি ব্যাংকের ডিএমডি পদ মর্যাদায় নিয়োগ দিয়েছে। ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ২০০১ সালে তিনি বিএনপি ক্ষমতা থাকা অবস্থা য় বিাএনপি সরকার দলীয় এজেন্ট হিসেবে বিভিন্ন বেসরকারী ব্যাংকে চাদাবাজি করে বেড়াতেন। তাকেও এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল পারভেজ তার ব্যাংকের ডিএমপি পদে নিয়োগ দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক, বিমা, হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কোচিং সেন্টার, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মাল্টি পারপাস সমিতিসহ ৫৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠায় র্যাব-পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছেও। এসব প্রতিষ্ঠানকে আগে থেকেই নজরদারিতে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, এ কাজের সঙ্গে দেশে কার্যত চারটি গোয়েন্দা সংস্থাও জড়িত রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কখনও নিজেরা আবার কখনও ব্যাংকের সহযোগিতা নেবেন।
সরকার মনে করছে, ওইসব প্রতিষ্ঠান একদিকে যেমন জামায়াত ও শিবিরের দর্লীয় নেতাদের নিয়োগ দিয়ে অর্থ সহায়তা দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করছে, তেমনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জামায়াত-শিবির সমর্থক বা কর্মীদের একটি বড় অংশ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কাজে সক্রিয় রয়েছে।
পাশাপাশি এসব কর্মকর্তা জঙ্গি অর্থায়নসহ সরকারবিরোধী বা দেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে এমন কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে বলেও মনে করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্ট পরিচালক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম, ঠিকানা ও তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত তথ্য অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
কয়েক বছর আগেই জামায়াতের মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ নজরদারি করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই নির্দেশে বিভিন্ন ব্যবসায়িক ও আর্থিক লেনদেন নিয়ন্ত্রণকারী অন্য সরকারি সংস্থাগুলোকেও নজরদারি বাড়াতে বলা হয়। সে সময় অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন সরকারের উদ্বেগের কারণ। তাই সংগঠনটির মালিকানাধীন ব্যাংক এবং লাভজনক সব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন ও আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর নজরদারি নিশ্চিত করা আবশ্যক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে জামায়াত-শিবিরের দলীয় বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডের প্রচার চালাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বৈদেশিক সাহায্যের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে আনা হয়েছে। সেসব অর্থ সংগঠনের পেছনে ব্যয় করার পাশাপাশি বিভিন্ন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী সংগঠনকে আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে।
জানা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, আবাসন প্রতিষ্ঠান, পরিবহন কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং সেন্টার, স্কুল-কলেজের কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিভিন্ন সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে বলে এর আগে গোয়েন্দা তদন্তে উঠে এসেছে। গোয়েন্দা তথ্য বলছে এখন বেসরকারী কয়েকটি ব্যাংকও গোয়েন্দাদের নজরদারীতে রয়েছে। যার মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকের নামও রয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডের ওপরও নজরদারি করা হচ্ছে।