ভবন নির্মাণের যাবতীয় আইন-কানুন মেনে নকশা অনুমোদনের জন্য আবেদন করতে হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বরাবর। ভবন নির্মাণের এ নিয়ম মেনেই সংস্থাটির আওতাধীন মালিকরা নকশা অনুমোদনের আবেদনও করেন। কিন্তু অনুমোদন পাওয়ার পর নিয়ম ভাঙার অভিযোগ রয়েছে অনেক ভবন মালিকের বিরুদ্ধে। এ কারণে নির্মাণাধীন ও নির্মিত ভবন পরিদর্শন করে নিয়মবহির্ভূত ভবনে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে রাজউক। তবে বিভিন্ন জটিলতার কারণে ও প্রশাসনিক দুর্বলতায় বেশ ধীরগতিতে চলছে উচ্ছেদ কার্যক্রম। এতে বেড়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গড়ে ওঠা ভবনের সংখ্যা। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজউককে অবশ্যই উচ্ছেদ কার্যক্রমে গতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সংস্থাটির পরিদর্শক ও পরিচালকদের কাজে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
রাজউকের মার্চের ইমারত নির্মাণের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই মাসে রাজউক ২ হাজার ১১১টি ভবন পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০৮টিতেই ব্যত্যয় পাওয়া গেছে। উচ্ছেদ পরিচালিত হয়েছে মাত্র ১৩৫টি ভবনে, যা পরিদর্শনের তুলনায় অনেক কম বলে মন্তব্য করছেন খোদ রাজউক কর্মকর্তারাই।
উচ্ছেদে ধীরগতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন সংস্থাটির পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ১) প্রকৌশলী মো. মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, ‘রাজউকের বেশকিছু সীমাবদ্ধতার কারণেই উচ্ছেদ কার্যক্রমে গতি কমে গেছে। আমাদের বড় সমস্যা হলো নিজস্ব কোনো পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট নেই। কোনো ভবনে ব্যত্যয় প্রমাণ হওয়ার পর সেখানে উচ্ছেদে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক পুলিশ চেয়ে প্রশাসনকে চিঠি দিই। পুলিশ পেতে দেরি হয় বলেই উচ্ছেদ অভিযান সময়মতো পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। আসলে রাজউকের মতো এত বড় একটা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাহিনী ছাড়া চলা সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে আমরা বারবার বলেও আসছি।’
সংস্থাটির ইমারত পরিদর্শকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্ছেদকাজে ধীরগতির জন্য রাজউকের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কোনো ভবনে ব্যত্যয় পেলে পরিদর্শকরা সে ভবনে প্রথমে নোটিস দেন। নোটিস দেয়ার পর ভবন মালিকরা পরিদর্শককে বিভিন্ন উপায়ে হাতে রেখে উচ্ছেদকাজ আটকে দেয়ার ফন্দিফিকির খোঁজেন বলে জানান কয়েকজন ইমারত পরিদর্শক। অনেক সময় নোটিস বা ভবনের ব্যত্যয়ের বিষয়ে অফিসে প্রতিবেদন জমা না দিতে পরিদর্শকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। একাধিক পরিদর্শক জানিয়েছেন, কোনো কোনো ভবনে বারবার নোটিস দেয়ার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উচ্ছেদ কার্যক্রমে আগ্রহ কম দেখা যায়।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, নির্মাণাধীন ভবন ও নির্মিত ভবন দুই ক্যাটাগরিতে পরিদর্শকরা পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনে কোনো ব্যত্যয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নোটিস দিয়ে সংশোধনের জন্য বলা হয়। টানা তিনবার নোটিস দেয়ার পর যদি তা সংশোধন করা না হয় তাহলে রাজউকের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ পরিচালিত হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, ভবনের ব্যত্যয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নোটিস দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা পুরোপুরি মানছেন না খোদ পরিদর্শকরা। বিষয়টি বড় ধরনের অনিয়ম বলে মন্তব্য করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
রাজউকের মার্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই মাসে ২ হাজার ১১১টি ভবন পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণাধীন ভবন ১ হাজার ৭৯৪টি। পরিদর্শন করে সংস্থাটি দেখেছে, ১ হাজার ৫৫টি ভবনে কোনো না কোনোভাবে নিয়মের ব্যত্যয় রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ব্যত্যয় পাওয়া প্রতিটি ভবন মালিককে নোটিস দেয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৮৭৪ ভবন মালিককে দেয়া হয়েছে নোটিস। বাকি ২০৮ ভবন মালিককে চিঠি দেননি সংস্থার ইমারত পরিদর্শকরা।
একইভাবে মার্চে রাজউকের ইমারত পরিদর্শকরা ৩১৭টি নির্মিত ভবন পরিদর্শন করে ২৫৩টি ভবনে ব্যত্যয় পেয়েছেন। এখানেও শতভাগ ভবন মালিককে নোটিস দেয়া হয়নি। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২২১টি নির্মিত ভবন মালিককে নোটিস দিয়েছেন রাজউকের পরিদর্শকরা। বাকি ৩২টি ভবনে ব্যত্যয় পাওয়া সত্ত্বেও কোনো ধরনের নোটিস ইস্যু করা হয়নি রাজউকের পক্ষ থেকে।
নগরবিদরা বলছেন, রাজউকের পরিদর্শনে ভবনে ব্যত্যয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নোটিস ইস্যু করা সংস্থাটির নিয়মিত কাজ। এ কাজ যদি শতভাগ পালন করা না হয় তাহলে অন্য ভবন মালিকরাও ব্যত্যয় করতে উৎসাহিত হবেন। তাছাড়া নোটিস ইস্যুর গাফিলতিও ধীরগতির উচ্ছেদের বড় কারণ বলে মন্তব্য করেছেন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘পরিদর্শকদের কাজই পরিদর্শন করে ভবনে কোনো ব্যত্যয় পেলে ওই ভবন মালিককে সঙ্গে সঙ্গে নোটিস দেয়া। এখানে কেউ বাদ পড়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাজউকের ইমারত পরিদর্শকরা নোটিস দেয়ার সহজ কাজটিও শতভাগ করতে পারছে না। ফলে উচ্ছেদেও দেরি হচ্ছে। আর এ সুযোগে ত্রুটিপূর্ণ ভবন দাঁড়িয়ে যায়। এভাবে যখন ভবনের পর ভবন নির্মাণ হয়ে যায় তখন রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভবন নির্মাণ হয়ে গেছে। এখন আর কিছু করার নেই।’
রাজউকের উচ্ছেদ অভিযানে ধীরগতির বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজউকের মতো একটি সংস্থার নিজস্ব পুলিশ থাকা উচিত। দেখা গেল উচ্ছেদের দিনক্ষণ ঠিক হলো, কিন্তু সেদিন পুলিশ পাওয়া গেল না। তার মানে আবার অনেক দিনের জন্য উচ্ছেদ পিছিয়ে গেল। এছাড়া রাজউকের বর্তমান যে সক্ষমতা রয়েছে সেটাকে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজে লাগানো গেলে এক মাসের মধ্যে সংস্থাটির উচ্ছেদ কার্যক্রম অন্তত দ্বিগুণ-তিন গুণ করা সম্ভব।’
সার্বিক বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, ‘এখন থেকে আর রাজউকের পরিদর্শকদের কাজে গাফিলতির সুযোগ নেই। ভবনে ব্যত্যয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নোটিস দিতে হবে। ভবনে ব্যত্যয়ের সঙ্গে জড়িত অফিসারকেও আমরা জবাবদিহির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পাশাপাশি উচ্ছেদ কার্যক্রমও যেন আরো দ্রুত হয় সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।’